sakerhosen Trainer 2 years ago |
শেষের রাত্রি
“মাসি ! ”
“ঘুমোও, যতীন, রাত হল যে ।”
“হোক-না রাত,আমার দিন তো বেশি নেই । আমি বলছিলুম,মণিকে তার বাপের বাড়ি— ভুলে যাচ্ছি,ওর বাপ এখন কোথায়—”
“সীতারামপুরে ।”
“হাঁ সীতারামপুরে । সেইখানে মণিকে পাঠিয়ে দাও, আরো কতদিন ও রোগীর সেবা করবে । ওর শরীর তো তেমন শক্ত নয় ।”
“শোনো একবার ! এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইবেই বা কেন ।”
“ডাক্তারেরা কী বলেছে সে কথা কি সে—”
“তা সে নাই জানল— চোখে তো দেখতে পাচ্ছে । সেদিন বাপের বাড়ি যাবার কথা যেমন একটু ইশারায় বলা অমনি বউ কেঁদে অস্থির ।”
মাসির এই কথাটার মধ্যে সত্যের কিছু অপলাপ ছিল, সে কথা বলা আবশ্যক । মণির সঙ্গে সেদিন তাঁর এই প্রসঙ্গে যে আলাপ হইয়াছিল সেটা নিম্নলিখিত-মতো ।
“বউ,তোমার বাপের বাড়ি থেকে কিছু খবর এসেছে বুঝি ? তোমার জাঠততো ভাই অনাথকে দেখলুম যেন ।
হাঁ, মা ব’লে পাঠিয়েছেন, আসছে শুক্রবারে আমার ছোটো বোনের অন্নপ্রাশন । তাই ভাবছি—”
“বেশ তো বাছা, একগাছি সোনার হার পাঠিয়ে দাও, তোমার মা খুশি হবেন।”
“ভাবছি, আমি যাব। আমার ছোটো বোনকে তো দেখিনি, দেখতে ইচ্ছে করে।”
“সে কী কথা, যতীনকে একলা ফেলে যাবে ? ডাক্তার কী বলেছে শুনেছ তো? ”
“ ডাক্তার তো বলছিল, এখনো তেমন বিশেষ—”
“তা যাই বলুক, ওর এই দশা দেখে যাবে কী ক’রে।”
“আমার তিন ভাইয়ের পরে এই একটি বোন, বড়ো আদরের মেয়ে– শুনেছি, ধুম করে অন্নপ্রাশন হবে— আমি না গেলে মা ভারি—”
“তোমার মায়ের ভাব, বাছা, আমি বুঝতে পারি নে। কিন্তু যতীনের এই সময়ে তুমি যদি যাও, তোমার বাবা রাগ করবেন, সে আমি বলে রাখছি।”
“তা জানি । তোমাকে এক লাইন লিখে দিতে হবে মাসি, যে কোনো ভাবনার কথা নেই— আমি গেলে বিশেষ কোনো—”
“তুমি গেলে কোনো ক্ষতিই নেই সে কি জানি নে । কিন্তু তোমার বাপকে যদি লিখতেই হয়, আমার মনে যা আছে সব খুলেই লিখব।”
“আচ্ছা, বেশ— তুমি লিখো না । আমি ওঁকে গিয়ে বললেই উনি—”
“দেখো বউ, অনেক সয়েছি— কিন্তু এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও, কিছুতেই সইব না । তোমার বাবা তোমাকে ভালো রকমই চেনেন, তাঁকে ভোলাতে পারবে না ।”
এই বলিয়া মাসি চলিয়া আসিলেন । মণি খানিকক্ষণের জন্য রাগ করিয়া বিছানায় উপর পড়িয়া রহিল ।
পাশের বাড়ি হইতে সই আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কি সই, গোসা কেন ।”
“ দেখো দেখি ভাই, আমার একমাত্র বোনের অন্নপ্রাশন— এরা আমাকে যেতে দিতে চায় না ।”
“ওমা , সে কী কথা, যাবে কোথায় । স্বামী যে রোগে শুষছে ।”
“আমি তো কিছুই করি নে, করিতে পারিও নে ; বাড়িতে সবাই চুপচাপ ,আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে । এমন ক’রে আমি থাকিতে পারি নে, তা বলছি ! ”
“তুমি ধন্যি মেয়েমানুষ যা হোক ।”
“তা আমি, ভাই, তোমাদের মতো লোক দেখানে ভান করতে পারি নে । পাছে কেউ কিছু মনে করে বলে মুখ গুঁজড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা আমার কর্ম নয়।”
“তা, কী করবে শুনি ।”
“আমি যাবই, আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না ।”
“ইস্, তেজ দেখে আর বাঁচি নে । চললুম, আমার কাজ আছে ।”
২
বাপের বাড়ি যাইবার প্রসঙ্গে মণি কাঁদিয়াছে— এই খবরে যতীন বিচলিত হইয়া বালিশটাকে পিঠের কাছে টানিয়া তুলিল এবং একটু উঠিয়া হেলান দিয়া বসিল । বলিল, “মাসি, এই জানালাটা আর-একটু খুলে দাও,আর এই আলোটা এ ঘরে দরকার নেই ।”
জানালা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতো রোগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইল । কত যুগের কত মৃত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল ।
যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল । সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মোটা মোটা জলের ফোঁটার ভরা— সে জল যেন আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য ভরিয়া রহিল ।
অনেকক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিত হইলেন । ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে ।
এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “মাসি,তোমরা কিন্তু বারবার মনে করে এসেছ,মণির মন চঞ্চল,আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি । কিন্তু দেখো—”
“না,বাবা,ভুল বুঝেছিলুম– সময় হলেই মানুষকে চেনা যায় ! ”
“মাসি ! ”
“যতীন, ঘুমোও, বাবা ।”
“আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও ! বিরক্ত হোয়ো না মাসি ।”
“আচ্ছা, বলো,বাবা ।”
“আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতে কত সময় লাগে ! একদিন যখন মনে করতুম, আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি । তোমরা তখন—”
“না, বাবা, অমন কথা বোলো না— আমিও সহ্য করেছি ।”
“মন তো মাটির ঢেলা নয়, কুড়িয়ে নিলেই তো নেওয়া যায় না । আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনো বোঝে নি; কোনো একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর—”
“ঠিক কথা, যতীন ।”
“সেইজন্যই ওর ছেলেমানুষিতে কোনোদিন কিছু মনে মরি নি ।”
মাসি এ কথার কোনো উত্তর করিলেন না; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন । কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাট আসিয়াছে তবু ঘরে যায় নাই । কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া ; একান্ত ইচ্ছা,মণি আসিয়া মাথায়
Alert message goes here